Sun Sun Sun Sun Sun
English

আঞ্চলিক সমিতি নিয়ে কিছু কথা

|| এম হেলাল ||
“স্ব-স্ব উপজেলার উন্নয়নের ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের পরিকল্পনা ও মনোভাব দেশপ্রেমেরই অংশ। নিজের উপজেলার উন্নয়নের কথা ভাবা এবং পরিকল্পনা গ্রহণ করা, সমিতির মাধ্যমে নিজ এলাকার অভাব-অভিযোগ এবং সমস্যার প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মধ্যে আঞ্চলিকতার কোন গন্ধ নাই। ঢাকার এলিট সম্প্রদায়ের নগরায়ন প্রক্রিয়া কিংবা রাজধানীর আধুনিক জীবন গ্রাম-বাংলার সংস্কৃতির বন্ধনের সম্পর্ক এখনও ছিন্ন করতে পারে নাই, আঞ্চলিক সমিতিগুলিই তার বড় প্রমাণ। সম্পর্ক যখন ছিন্ন হয়ই নাই তখন সেই সম্পর্ককে কিভাবে গঠনমূলক কাজে লাগানো যায়, তা উদ্ভাবন করাই এইসব সমিতির লক্ষ্য হওয়া উচিত।” কথাগুলো ঠিক এভাবেই এক জনসভায় বলেছিলেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। কিন্ত এ দায়িত্ব পালনে আঞ্চলিক সমিতিগুলো কতটুকু সক্ষম হচ্ছে, তা ভেবে দেখা দরকার।

বাংলাদেশে আঞ্চলিক সমিতির সংখ্যা নেহাত কম নয় এবং দিন যতই গড়াচ্ছে এসব সমিতির সংখ্যাও অনেকটা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। তাই এখন দেখা যাচ্ছে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য প্রধান প্রধান শহরে বিভাগীয়, আন্তঃ বিভাগীয়, আন্ত জেলা, বৃহত্তর জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়নের নামেও এই আঞ্চলিক সমিতির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। পারষ্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতা এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তিতে কল্যাণমুখী তৎপরতাকে সামনে রেখে এসব সমিতি নিজ নিজ অঞ্চলকে প্রতিনিধিত্ব করার দাবি রাখছে।

কাজেই, এসব আঞ্চলিক সমিতির দায়-দায়িত্ব যেমন ব্যাপক, তদ্রুপ এসব সমিতিকে ঘিরে আঞ্চলিক লোকজনের প্রত্যাশাও অনেক বেশি। যারা এই সমিতির সদস্য বা সদস্যা তাদেরকে নিয়ে এ সমিতির কার্যক্রম আবর্তিত হবে, তাই শুধু নয় বরং সদস্য-সদস্যাদের ব্যাপারতো আছেই, পাশাপাশি নিজ নিজ এলাকার সার্বিক অবস্থা নিয়ে এসব সমিতিকে কার্যক্রম পরিচালনা করার প্রত্যাশা পূরণ করার জন্যও অঙ্গীকারবদ্ধ থাকতে হয়। তাই এই আঞ্চলিক সমিতির পক্ষ থেকে প্রবাসী আঞ্চলিক ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশুনায় উৎসাহ যোগানোর উদ্দেশ্যে বৃত্তি প্রদান করা হবে, আগত এলাকার নতুন লোকজন যাতে আগত শহরে পুনর্বাসিত হয় তার ব্যবস্থা করা হবে, আঞ্চলিক কৃষ্টি, সংস্কৃতি, সহিত্যচর্চায় অব্যাহত উৎসাহ প্রদান করা হবে, ‘আঞ্চলিক সমস্যাসমূহকে তুলে ধরে তার সমাধানের চেষ্টা চালানো হবে এটাই স্বাভাবিক। আর এসব কর্ম সম্পাদনের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সমিতিসমূহের যোগাযোগও যথেষ্ট আছে। কেননা, সংঘবদ্ধতা এসব সমিতির ভিত্তি। আর কথায় আছে, সংঘবদ্ধভাবে যেকোন কর্ম সম্পাদন অত্যন্ত সহজতর হয়ে ওঠে। পাশাপাশি একই অঞ্চলের লোকজনের ভেতর এসব সমিতির একটি ভাল ইমেজ আছে। সমিতির দায়-দায়িত্ব সম্পাদন করতে, সমিতির দাবিসমূহ পূরণের প্রচেষ্টায় আঞ্চলিক লোকজনও কম-বেশি সাহায্য-সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে। তাই দেখা যায়, স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরেও যেসব কার্য সম্পন্ন করা যায় না, এসব সমিতির পক্ষ থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করায় তা বেশ সহজসাধ্য কর্ম বলে বিবেচিত হয়। অর্থাৎ এককথায় এসব সমিতি এলাকা ও এলাকার প্রবাসী জনসাধারণের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করাসহ এলাকার সার্বিক ব্যাপারে যেসব দায়-দায়িত্ব প্রতিপালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তা সম্পন্ন করতে পারে। বলা বাহুল্য, এসব যে এরূপ আঞ্চলিক সমিতিসমূহ সম্পাদন করবে, এমন প্রত্যাশাও আঞ্চলিক লোকজনদের থাকে।

অবশ্য এও ঠিক, এসব আঞ্চলিক সমিতিতে অন্যান্য সমিতির মত নেতৃত্বের কোন্দল, সমষ্টি স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি স্বার্থের প্রাধান্য দান, সমিতির নাম ভাঙ্গিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের প্রবণতা, এলাকাগত রেষারেষির মত জঘন্য ধরনের সীমাবদ্ধতা কাজ করার অবকাশ পায়। কাজেই দেখা যাচ্ছে, কার্যকরণে প্রতিবন্ধকতাও তদ্রুপ আছে। পাশাপাশি ইতিহাসের ভাষ্যও আছে, যেকোন মহৎ উদ্যোগ বিনা অন্তরায়ে বাস্তবায়িত হয় না। সেসাথে আরও বলতে হচ্ছে যে, প্রতিবন্ধকতা আছে বলেই কর্ম সম্পাদনে যে কৃতিত্ব রয়েছে, তাতে তৃপ্তিও অন্যরকম। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, আঞ্চলিক সমিতির যে অন্তরায়, তা সঠিক নেতৃত্বে সময়োপযোগী কর্মপন্থা নির্ধারণ করে অপসারণ সম্ভব। পূর্বেও এ ধরনের অনেক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা হয়েছে যা ইতিহাসে স্পষ্ট।

আঞ্চলিক সমিতির ক্ষেত্রে যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত থাকুক না কেন, যে সম্ভাবনা থাকুক না কেন, আঞ্চলিক সমিতিসমূহকে ঘিরে এলাকাবাসীর প্রত্যাশা যত তীব্র হোক না কেন, সমিতির প্রতিশ্রুতি যা হোক না কেন, বর্তমান সময়ে এসব আঞ্চলিক সমিতি যেসব কর্মপন্থা স্থির করেছে, দৃষ্টান্ত-সম্ভাবনা-প্রত্যাশা বা প্রতিশ্রুতিকে বহুলাংশে অস্বীকার করছে, তা নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না। বরং এসব সমিতির কার্যকলাপ দেখলে মনে হয়, ব্যক্তি বিশেষের স্বার্থের জন্য এসব সমিতি গঠিত হয়েছে এবং এগুলোর নাম ভাঙ্গিয়ে ব্যক্তি বিশেষই ফায়দা লুটে নিচ্ছে। আরও লক্ষ্যণীয় এই ব্যক্তি বিশেষের চক্রান্তে অনেক সময় সমিতির ভাল উদ্যোগও শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এমন দেখা গেছে কোন কোন উদ্যোক্তা উদ্যোগ গ্রহণ করে একটি আঞ্চলিক সমিতি গঠন করেছে, ভাল কাজ করার কর্মপন্থাও স্থির করছে, ঠিক সেখানে ভূঁইফোড় কেউ এসে সমস্তই পণ্ড করে দিচ্ছে কিংবা নিজস্ব স্বার্থে পুরো উদ্যোগটাকে ব্যবহার করছে অথবা এ উদ্যোগকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন উদ্যোগে আরেকটি একই উদ্দেশ্যের সমিতি গড়ে তা দিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজের স্বার্থ হাসিল করছে অথবা পুরো সমিতিকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য অন্যভাবে ষড়যন্ত্র করছে। এ প্রসঙ্গে ‘লক্ষ্মীপুর জেলা ছাত্র-ছাত্রী কল্যাণ সমিতির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

এই সমিতি প্রথমেই মহকুমা সমিতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং লক্ষ্মীপুরকে জেলা করার দাবি জানিয়ে পত্র-পত্রিকায় বিবৃতি, প্রশাসনিক তদবির ইত্যাদির মাধ্যমে মহকুমার জেলায় উন্নীত করার পর জেলা সমিতি হিসেবে রূপলাভ করে। প্রতিষ্ঠালগ্নে ‘লক্ষ্মীপুর জেলা ছাত্র-ছাত্রী কল্যাণ সমিতি’ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতা লাভ করে এবং স্বল্প সময়ের পরিসরে এ সমিতি যে কার্যক্রম পরিচালনা করে, তা যথেষ্ট ভাল প্রমাণিত হওয়ায় অনেকের সপ্রশংস দৃষ্টি আর্কষণে সক্ষম হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কতিপয় স্বার্থপর ব্যক্তির ঈর্ষাজনিত ষড়যন্ত্রের ঘৃণ্য তৎপরতায় এ সমিতির উদ্যোক্তারা পরবর্তী কর্ম সম্পাদনে অনেকখানি নিরাশ হয়ে পড়ে। লক্ষ্মীপুর জেলা ছাত্র-ছাত্রী কল্যাণ সমিতির অবস্থা তারপরে কি দাঁড়ায়, তা বিশদভাবে বলার অপেক্ষা রাখে বলে মনে হয় না। এক ‘লক্ষ্মীপুর জেলা ছাত্র-ছাত্রী কল্যাণ সমিতি’ই নয়, এরূপ বহু সমিতি আছে যার পরিণতি ঐ সমিতির মত বা তারও চেয়ে খারাপ হয়েছে। কিন্তু আঞ্চলিক সমিতির অস্তিত্ব তবু থাকছে এবং বলা যায়, এসব সমিতির আয়ুষ্কাল অচিরেই শেষ হবে না। কিন্তু সমুদয় ব্যাপার-স্যাপার পর্যালোচনা করলে এটাও বলা বোধ করি অযৌক্তিক হবে না যে, ইত্যবসরে এসব সমিতি অনেকাংশে রাবার স্ট্যাম্পসর্বস্ব সমিতি হয়ে উঠেছে এবং ব্যক্তিস্বার্থে সেসব রাবার স্ট্যাম্পের ব্যবহার ছাড়া অন্য কোন কল্যাণধর্মী কর্মতৎপরতায় তা ব্যবহৃত হচ্ছে না।

কিন্তু এসব আঞ্চলিক সমিতি যদি সুষ্ঠুভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করে তবে সার্বিকভাবে গোটা দেশেরই কল্যাণমুখী তৎপরতা বেশ জোরদার হয়। কেননা, অঞ্চলসমূহের সার্বিক সমন্বয়েইতো গোটা দেশ এবং এসব অঞ্চলের উন্নয়ন প্রচেষ্টা চললে তাতে সার্বিক অর্থে দেশেরই উন্নয়ন প্রচেষ্টা চলে। কারণ আমরা জানি, আঞ্চলিক সমিতিসমূহ অঞ্চলকে প্রতিনিধিত্ব করে বিধায় সেখানকার সুবিধা-অসুবিধার দিক নির্দেশ করে সেখানকার উন্নয়নের জন্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণসহ অন্যান্য তৎপরতা চালাতে পারে। আর অসুবিধার কথা না জানা থাকলে সুবিধা বা উন্নয়নের তৎপরতার সৃষ্টি সম্ভব নয়।

তাই আমরা আশা করব, এই আঞ্চলিক সমিতিসমূহ রাবার স্ট্যাম্পের ভূমিকা পিছনে ফেলে উপরোল্লিখিত কল্যাণমুখী কর্ম-তৎপরতার দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসবে। এতে আর কিছু না হোক, তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ বলে পরিচিত আমাদের বাংলাদেশের কিছুটা উন্নয়নমুখী অগ্রগতি হবে এটা নিশ্চিত।

(১৯৮৯ সালে লক্ষ্মীপুর বার্তা পত্রিকার ৩য় সংখ্যায় মুদ্রিত)