Sun Sun Sun Sun Sun
English

কোচিং ছাড়াই সন্তানের নিজ প্রচেষ্টায়
সৃজনশীল করে তোলার সহজ পদ্ধতি

|| ড. এম হেলাল ||
আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সৃজনশীলতা বৃদ্ধি ও মেধা বিকাশের পথে অন্তরায় হয়ে আছে প্রচলিত কোচিং ও নোটশিক্ষা পদ্ধতি। কোচিংয়ে অভিভাবকের কষ্টার্জিত অর্থেরই শুধু অপচয় হয় না, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর সময় ও শ্রমের অপচয়সহ হাজারো ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে পরিবার, সমাজ ও জাতির মান হয়ে পড়ছে নিম্নগামী। শিক্ষার্থীকে জীবনভর পরনির্ভরশীল মানসিকতায় আবিষ্ট ও পর্যুদস্ত করে ফেলছে এ কোচিং পদ্ধতি।

হুজুগেপনায় পড়ে কোচিং ও নোটবুকের যে ছবক প্রাইমারি স্কুলেই ধরিয়ে দেন প্রিয় পিতামাতা, এরপর কলেজে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েও সেই কোচিং ও নোটবুক ছাড়া চলতে পারে না অধিকাংশ শিক্ষার্থী। বিশাল জাতীয় বাজেটে চালিত ন্যুব্জ ও পরনির্ভরশীল এ শিক্ষা পদ্ধতির ১৬/১৭টি ধাপ শেষে তথা বর্ষে বর্ষে পরীক্ষা বৈতরণি পার হওয়া বেকার শিক্ষিতের সংখ্যা এই ছোট্ট দেশে এখন প্রায় ২৬ লক্ষ। তাই শিক্ষাঙ্গন থেকে কোচিং ও নোটবুককে চিরবিদায় জানানো জরুরি। সে লক্ষ্যে আমার স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অভিজ্ঞতায় কোচিং-সমস্যার একটি সহজ সমাধান বলছি - যার নাম দিয়েছি পড়ালেখায় ক্যাম্পাস পদ্ধতি অর্থাৎ Study in Campus Method.

আগামীদিন ক্লাসে কী পাঠ আছে বা কী পড়ানো হবে, তা পূর্বদিন অথবা ক্লাসের পূর্বে যেকোনো সময়ে শিক্ষার্থীকে একনজর দেখতে হবে; কিছু বোঝার চেষ্টা করতে হবে। এরপর শিক্ষক ক্লাসে পাঠদানকালীন শিক্ষার্থী তা ভালোভাবে শুনে ও বুঝে নেবে; না বুঝতে পারলে অবশ্যই শিক্ষককে প্রশ্ন করবে। তাতেও বুঝতে না পারলে ক্লাসশেষে বা ক্লাসের বিরতিতে কিংবা পরবর্তী ক্লাসের শুরুতে শিক্ষকের নিকট থেকে শিক্ষার্থী তা বুঝে নেবে। এক্ষেত্রে বোঝাতে চান না বলে শিক্ষকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ বা অনুযোগ তোলা হয়, তা আমার নিকট অমূলক; বরং তা শিক্ষার্থীরই দুর্বল চিত্তের পরিচায়ক।

আমার শিক্ষাজীবনে আমি শিক্ষকের এরূপ নেতিবাচক আচরণ দেখিনি। কেবল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একবার এক অধ্যাপকের যৎসামান্য অবহেলায় পড়েছিলাম। স্যার আমাকে সময় কম দিয়ে বলেছিলেন, I’m associated with eight institutions and Dhaka University is one of them. এতে স্যার কীভাবে আমার গঠনমূলক প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে সে প্রতিবাদের প্রশংসাও করেছেন, তা বিভিন্ন লেখায় উল্লেখ করেছি বলে এখানে পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানমতে- ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের এরূপ প্রতিবাদ যেমনি যোগ্য শিক্ষার্থীর সৎ সাহসের পরিচায়ক, তেমনি এরূপ প্রতিবাদে আত্মশুদ্ধির আন্তরিক ইচ্ছাও যোগ্য শিক্ষকের পরিচায়ক। শিক্ষাজীবনে যে শিক্ষার্থী এরূপ অন্যায় ও অশুভর বিরুদ্ধে সৎসাহসী প্রতিবাদে কুণ্ঠিত হয়, তাকে দিয়ে দেশ ও জাতির সংস্কার, কল্যাণ বা উন্নয়ন আশা করা বৃথা।

আমার মতে, কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান থেকে বঞ্চিত করলে শিক্ষার্থী যদি প্রতিষ্ঠান প্রধান বা বিভাগীয় প্রধানকে লিখিত দরখাস্তের মাধ্যমে অভিযোগ করে এবং ম্যানেজিং কমিটির প্রধানকে ও শিক্ষা মন্ত্রী বা সচিবকে অভিযোগের কপি দেয় অথবা অভিভাবককে বলার পর অভিভাবক সে শিক্ষকের দায়িত্বহীনতার গঠনমূলক প্রতিবাদ করেন, তাহলে সমস্যার সমূলে সমাধান একেবারেই সহজ।

আদর্শ শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীর অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও সপ্রশংস কৃতজ্ঞতা এবং দায়িত্বহীন শিক্ষকের বিরুদ্ধে তথা শিক্ষকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীর বিরোধিতা, ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিবাদের মানসিকতা তৈরি করার দায়িত্ব কিন্তু অভিভাবকের তথা পরিবারের। অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে শিক্ষার পূর্বে পারিবারিক সৎ ও মহৎ শিক্ষায় দীক্ষিত হয়ে থাকলে বাইরের প্রাতিষ্ঠানিক বা সামাজিক বিরূপ পরিস্থিতিতে তাকে পড়তে হয় না; পড়লেও তা কাটিয়ে উঠে সে পরিস্থিতি জয় করা কঠিন হয় না। অর্থাৎ পরিস্থিতিজনিত এসব সমস্যা শিক্ষকের নয়, সমস্যা আমাদের সন্তানদের। অনুরূপভাবে এ সমস্যা সন্তানের নয়, সমস্যা আমাদের অভিভাবকদের; যারা একদিকে সন্তানের মানস গঠন ও ভবিষ্যত প্রস্তুতিতে ভূমিকা রাখতে পারছি না; অন্যদিকে অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে বরং অন্যায়কে হজম করে বা প্রশ্রয় দিয়ে নিজেরাই বহু অন্যায়ের কারাগারে বন্দি হয়ে যাচ্ছি। আমরা ভুলে যাচ্ছি-

অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে ॥

স্কুলে পাঠের পর আবার বিভিন্ন কোচিংয়ে নানারকম পাঠের বোঝায় বিপর্যস্ত শিক্ষার্থীর জীবন। শিক্ষাসহায়ক অন্যান্য কার্যক্রমে অংশগ্রহণে তার সময়-সুযোগ কোথায়! স্মার্টনেস ও কমনসেন্স অর্জন অথবা গল্প-উপন্যাস-বৈজ্ঞানিক কাহিনীর সৃজনশীল বই কতটুকুইবা পড়া হয় তার! খেলাধূলা করা কিংবা সহপাঠী ও সমবয়সীদের সাথে শেয়ারিং-কেয়ারিংয়ের সামাজিক আচার-আচরণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার সুযোগ কই! সব পেশাজীবীর চেয়ে এখন বেশি ব্যস্ত আমাদের কোমলমতি শিশু-কিশোররা। ব্যস্তসমস্ততায় পর্যুদস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা ও আত্মনির্ভরশীলতা।

কোচিং শিক্ষার ১ম শ্রেণি বা জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর চেয়ে কোচিংহীন তথা আত্মনির্ভর ও সৃষ্টিশীল স্মার্ট শিক্ষার্থীর কর্মজীবন, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন হয় অনেক বেশি সহজ ও নিষ্কন্টক, অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ ও সাফল্যের। জাতীয় জীবনেও সে রাখতে পারে অনেক বেশি কল্যাণকর অবদান।

মেধা বিধ্বংসী এ কোচিং এবং নোটশিক্ষা পদ্ধতি থেকে পরিত্রাণে কেউ আগ্রহী হয়েও সফল না হলে সেক্ষেত্রে ক্যাম্পাস পত্রিকায় লিখুন। আপনার সহযোগিতায় আমরা আপনার পাশেই আছি। আসুন, সৃজনশীলতা ও আত্মনির্ভরশীলতার এরূপ সহজ বিষয় চর্চার মাধ্যমে শিক্ষাসহ আমাদের জাতীয় বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে ফেলি।

শুভ হোক সকল মঙ্গল প্রয়াস।