জীবন চলার পথে খেয়ালের বশে বা অচৈতন্যে, অনভিজ্ঞতা বা অজ্ঞানতায় মানুষ ভুল-ত্রুটি করবে, অন্যায় করবে এটি অপ্রত্যাশিত হলেও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সচেতন মুহূর্তে সেই অন্যায় বা ভুল-ত্রুটির বিষয়ে আত্মউপলব্ধি আসা জরুরি, যা মনুষ্যত্বের তথা মানবিক গুণাবলীর পরিচায়ক। আর যার মধ্যে এ আত্মউপলব্ধির প্রবণতা দেখা যায় না, তাকে মনুষ্যত্ববিবর্জিত বলেই ধরে নেয়া যায়।
রাগের বশে, খেয়ালে-বেখেয়ালে কিংবা অনুরূপ কোনো নেগেটিভ ইমোশনে পড়ে অনেকেই বিভিন্ন ভুল বা অন্যায় করে ফেলেন যা অন্যরা হয়ত সাময়িক মেনে নেন, তবে মনে নেন না। কিন্তু পরবর্তীতে সে ভুল বা অন্যায় সম্পর্কে নিজের উপলব্ধি, অনুশোচনা এবং দুঃখপ্রকাশ বা ক্ষমাপ্রার্থনা না করাকে কেউই মেনে নেন না, মনে নেয়াতো দূরের কথা। তাই ভুলত্রুটি বা অন্যায়ের অসৌন্দর্য সম্পর্কে আত্মসচেতনতা ও আত্মউপলব্ধির মাধ্যমে নিজকে সর্বদাই পরিশীলিত, মার্জিত ও বিশুদ্ধ করা উন্নত বা মহৎ জীবনের পূর্বশর্ত।
সুন্দর, মহৎ ও সুস্থ জীবনযাপনে এবং সম্মুখে চলার পথ কন্টকমুক্ত ও গতিশীল করতে প্রয়োজন আত্মঅনুসন্ধানের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে নিজের অবস্থান সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি। নিজেকে পরিচ্ছন্ন, স্বচ্ছ ও শুদ্ধ করতে হলে পাপ-পঙ্কিলতা ও ভুলত্রুটি কাটানো অত্যাবশ্যক এবং তা কাটানোর পূর্বশর্ত হচ্ছে এসবের সঠিক অস্তিত্ব নির্ণয় ও কার্যকারণ জানা। নিজের অজান্তেই নিজের মধ্যে বিভিন্ন কুপ্রবৃত্তি, দোষত্রুটি, হিংসা-বিদ্বেষ, অহমিকা, জটিলতা-কুটিলতা, সন্দেহ-সংশয় থেকে যায় যা নিরোগ, সুস্বাস্থ্য ও সাফল্যের প্রতিবন্ধক।
এ এক নিদারুণ ট্র্যাজেডি যে, আত্মউপলব্ধির অভাবে নিজের মধ্যে থাকা এসব নেতিবাচক বিষয়ের উপস্থিতির কথা অধিকাংশ মানুষই বুঝতে পারে না। তাই নেতিবাচক ও মন্দ বিষয় থেকে পরিত্রাণের প্রাথমিক ধাপ হচ্ছে নিজের মধ্যে এসবের অস্তিত্ব আছে কিনা তা আত্মঅনুসন্ধানের মাধ্যমে খতিয়ে দেখা এবং আত্মউপলব্ধিতে নিয়ে আসা। কারণ আত্মসমালোচনার চেয়ে সত্য লুকানোর প্রচেষ্টা যাদের মধ্যে প্রকট, তারা কখনো উন্নত মানুষ হতে পারে না। তারা কেবল অন্যের ভুলই ধরে, নিজের ভুল দেখে না।
ইচ্ছাশক্তি (Desire) থাকলে এ কাজটি একেবারে সহজ; আর না চাইলে অত্যন্ত কঠিন এবং কারো কারো জন্য অসম্ভবও বটে। অর্থাৎ এ অভিযানে সাফল্য অর্জনে প্রয়োজন সুকঠিন সদিচ্ছা, সুদৃঢ় আকাক্সক্ষা ও সুনিবিঢ় সাধনা এবং বিশেষ মানুষদের ততোধিক বিশেষ মনোবল। তবে এজন্য যে সদিচ্ছা, সরলতা ও সুশিক্ষা থাকা দরকার তা থেকে বঞ্চিত থাকে বেশিরভাগ মানুষ। তবু চেষ্টা করে যেতেই হবে কঠিন রোগ থেকে বেঁচে ওঠার প্রাণান্তকর চেষ্টার মতো। এ প্রচেষ্টায় সফল হলেই আপনি সুস্থ, সফল ও শান্তিময় জীবনের পথে এগিয়ে গেলেন। কারণ রোগমুক্তির প্রথম শর্ত যেমনি রোগের অবস্থান ও কারণ জানা, অর্থাৎ রোগ বুঝতে পারলেই আরোগ্যের ব্যবস্থা বা চিকিৎসা সহজ হয়ে যায় যেরূপ সেরূপ নিজের মধ্যকার ভালো-মন্দ সম্পর্কে আত্মঅনুসন্ধান ও আত্মউপলব্ধি সুস্থ ও সুন্দর জীবনের অন্যতম পূর্বশর্ত। পবিত্র কোরআনেও আছে যারা অপরাধ উপলব্ধি করে ফিরে আসতে পারে, তাদের প্রতি আল্লাহ ক্ষমাশীল।
প্রকৃতই আত্মউপলব্ধির পথে এগুনো মানেই সত্যের পথে এগুনো, সুন্দরের ভুবনে প্রবেশ। মহান দার্শনিক সক্রেটিস সেই যুগে বলে গেছেন Know Thyself অর্থাৎ নিজেকে জানো। ক্যাম্পাস`র স্লোগান Let us know ourselves; আসুন, আমরা সবাই নিজকে জানার মাধ্যমে উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি গড়ে তুলি।
এরূপ আত্মঅনুসন্ধান ও আত্মউপলব্ধিতে সক্ষমদের জন্যই রয়েছে ক্ষমা। আত্মউপলব্ধি ও অনুশোচনা ছাড়া অন্যের থেকে ক্ষমা অর্জন করে নিজের কোনো লাভ নেই বরং তাতে নিজের মধ্যে আত্মপ্রবঞ্চনাজনিত আরো কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ রোগ জন্ম নিতে পারে। ক্ষমা করে ক্ষমাকারী সুস্থ হয়ে গেলেন; কিন্তু অনুশোচনা ব্যতীত ক্ষমা পাওয়া মানে শুভেচ্ছাহীন উপহার বা কল্যাণহীন ভিক্ষা।
আত্মউপলব্ধি ও অনুশোচনার মানুষরা সর্বজন গ্রহণযোগ্য এবং জনপ্রিয়ও বটে। এভাবে মানুষের প্রিয় হওয়া মানে স্রষ্টার নৈকট্যলাভ; The words of the people are the words of God.
অনুশোচনার মানুষরা সুবোধ ও সহজ-সরল বলেই তারা যেমনি অন্যের কাছে ক্ষমাশীল, অপরাধমুক্ত ও আশীর্বাদপুষ্ট; তেমনি নিজের চর্চায় নিজেই সুস্থ-সুন্দর ও মহৎ। তাই যিনি যত বড় মাপের মানুষ, তিনি তত বেশি আত্মঅনুসন্ধানী-আত্মউপলব্ধ ও অনুশোচনার বিশুদ্ধ মানুষ; তিনি আয়নায় নিজের চেহারা দেখেন এবং মনের আয়না ও বিবেকের কাছে কঠিন শিকলে বন্দী থাকেন।
এভাবে আত্মঅনুসন্ধান, আত্মউপলব্ধি ও অনুশোচনার পরের পর্ব হচ্ছে ক্ষমাপ্রার্থনা। এরূপ অনুশোচনার পর্বেই অনেক পাপ-পঙ্কিলতা সাধারণত কেটে যায়, স্বচ্ছতা ও শুদ্ধতা চলে আসে। এরপরও ক্ষমাপ্রার্থনা এবং ক্ষমালাভ মানে হচ্ছে আত্মশুদ্ধির সার্টিফিকেট বা সনদলাভ।
তাই সারকথা হচ্ছে যার নিকট যে অন্যায় বা অপরাধ করেছি, তার নিকট তজ্জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হওয়া। আত্মঅনুশোচনা নিশ্চিত করে সরল ও কায়মনোবাক্যে ক্ষমাপ্রার্থী হতে পারলে ক্ষমালাভ অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যায়, বিশেষত স্রষ্টার কাছে। আর মানুষের কাছে? মানুষের ক্ষমা পাওয়া গেল কিনা, ক্ষেত্রবিশেষে এরূপ সংশয় থাকা অস্বাভাবিক নয়। বিশেষত বড় অন্যায় ও মিথ্যার ক্ষেত্রে। তাই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা ও ক্ষমালাভ সম্ভব না হলে সেক্ষেত্রে Self Command বা Autosuggesstion এর কৌশল অবলম্বন করা যায়। অর্থাৎ অনুশোচনার মাধ্যমে ক্ষমাপ্রার্থী হওয়ার মহৎ গুণে আপনি যে গুণান্বিত হলেন, সেই গুণের কথা চিন্তায় এনে স্রষ্টার মাধ্যমে ক্ষমাপ্রার্থী হওয়া যায়; অনেকটা জমি অগ্রক্রয় মামলার মতো। অর্থাৎ আপনার পার্শ্ববর্তী জমির মালিক তার জমি বিক্রি করতে চাইলে তা ক্রয়ের ক্ষেত্রে আপনি অগ্রাধিকারী। যদি তিনি আপনার কাছে জমি বিক্রি করতে ইচ্ছুক না হয়ে অন্যের কাছে বিক্রি করেন, তাহলে আপনি সরকারের ঘরে টাকা জমা দিয়ে ঐ জমি নিজ মালিকানায় নিয়ে নিতে পারেন।
এরূপ ক্ষমালাভের পর নিজকে এত স্বচ্ছ-সুস্থ-সবল, শক্তিশালী, আলোকিত ও Confident মনে হবে যে তখন যেকোনো রোগ-বালাই জয় এবং সুস্থ, সুন্দর ও আলোকিত সমৃদ্ধ জীবনলাভ একেবারেই সহজ হয়ে যাবে; সফলতা আসতে থাকবে একের পর এক।
উন্নত জীবনযাপনের এতরকম উপায় ও কলাকৌশল বা Art থাকতেও যারা খাসলতের দোষে, অহমিকা ও জটিলতা-কুটিলতার বশে অথবা সুবুদ্ধি ও সরল জ্ঞানের অভাবে এরূপ সহজ ও নিষ্কন্টক পথে এগুতে পারে না বা আসতে চায় না তারা কত বড় হতভাগ্য ও নির্বোধ!
তবে সাধু সাবধান! সহজ-সরল আত্মউপলব্ধি ও অনুশোচনা ছাড়া ক্ষমাপ্রার্থনা কিন্তু আরেক ছলনার শামিল। তাতে ক্ষমালাভ ও সুস্থ-সুন্দর হওয়াতো দূরের কথা বরং এতে আত্মদহন বেড়ে যেতে পারে। পবিত্র কোরআনে আছে ছলনাকারীরা আত্মদহনে জ্বলবে, আর সত্য ও ন্যায়ের ধারকদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ।