Sun Sun Sun Sun Sun
English

বেকারত্ব দূরীকরণে কারিগরী শিক্ষা

|| ড. এম হেলাল ||
শিক্ষাই হচ্ছে যে কোন জাতির মেরুদন্ড। আর শিক্ষিত জনশক্তিই হচ্ছে একটি জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের মূল শক্তি। বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম জনবহুল এবং দরিদ্র দেশগুলোর অন্যতম। পরিকল্পনা কমিশনের হিসাব মতে, ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের প্রকৃত জনসংখ্যা ছিল ১০ কোটি ৫৫ লাখ। ক্রমবর্ধিত জনসংখ্যা সমস্যাকেই সরকার দেশের এক নম্বর সমস্যা হিসেবে ঘোষণা করেছে। আবার এই জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশই বেকার। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান মোতাবেক দেশে বর্তমানে বেকারের সংখ্যা ১ কোটি ২৫ লাখ। একদিকে জনসংখ্যার ক্রমবর্ধিত চাপ, অন্যদিকে তীব্র বেকার সমস্যা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। অথচ এই জনবহুল দেশটির জনসংখ্যাকে যদি জনশক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব হয় তাহলে তা সম্পদে পরিণত হবে- বেকার সমস্যা নিরসনের পাশাপাশি দেশও হবে সমৃদ্ধ।

বিশ্বের সকল উন্নত দেশে শিক্ষিতের হার শতকরা একশতের কাছাকাছি হলেও আমরা এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছি। ১৯৮১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে শিক্ষিতের হার মাত্র শতকরা ২৩.৪ জন। আবার শিক্ষিত জনশক্তির বেশির ভাগই সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত। ফলে বেকার সমস্যা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- বেকার সমস্যা নিরসনকল্পে আমরা সাধারণ শিক্ষার প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করবো, না কারিগরী শিক্ষার প্রতি? বস্তুতঃপক্ষে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একথা আজ সত্য যে, জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করতে হলে কারিগরী শিক্ষার প্রতিই আমাদের বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা এ ধরনের শিক্ষার প্রসারে বিনিয়োগের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম, শিক্ষাও স্বল্পমেয়াদী এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অধিকতর সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সাধারণ শিক্ষা বিস্তারের অর্থ হচ্ছে বেকারত্ব সৃষ্টি তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ব্যাহত করা। এর কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ অত্যন্ত গরীব দেশ। শিক্ষাখাতে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ তার পক্ষে সম্ভব নয়। অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষায় উন্নয়ন বাজেটের বৃহদাংশ ব্যয় করা হলে তা বেকারত্ব দূরীকরণে তেমন ভূমিকা রাখবে না। তাছাড়া বাংলাদেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষই দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে। দীর্ঘমেয়াদী সাধারণ শিক্ষা গ্রহণ করার সঙ্গতি তাদের অনেকেরই নেই।

গ্রামের মানুষ শতকরা প্রায় ৭০ ভাগই ভূমিহীন। নদী ভাঙ্গন, ঝড়-ঝঞ্ঝা, বন্যা-মহামারীর মত প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও মনুষ্য-সৃষ্ট নানা দুর্বিপাকে পড়ে গ্রামাঞ্চলের ওইসব ছিন্নমূল মানুষ বাধ্য হয়ে ছুটে আসে শহর ও নগরের দিকে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগ গবেষণা কেন্দ্রের এক জরীপে দেখা যায় ঢাকা নগরীর এক চতুর্থাংশ অধিবাসী অর্থাৎ প্রায় ৮ লক্ষ ৮০ হাজার মানুষ বস্তিতে বাস করে।

বস্তিবাসীদের জীবন যাত্রা সম্বন্ধে আমরা সকলেই কম-বেশি অবহিত। বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের অভিশাপে তারা অভিশপ্ত। যেসব বস্তিবাসীর সামান্য কারিগরী জ্ঞান রয়েছে তারা অন্যদের চাইতে কিছুটা উন্নতমানের জীবন যাপন করে থাকে। অথচ প্রাতিষ্ঠানিক কারিগরী শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে পারলে তাদের বেকারত্বের অবসান সম্ভব।

গ্রাম ও শহরের দারিদ্র্য পীড়িত এই ব্যাপক জনগোষ্ঠীর বেকারত্ব দূরীকরণে কারিগরী শিক্ষা একমাত্র উপায় যা দ্বারা তাদেরকে জনশক্তিতে রূপান্তর করা যেতে পারে। সাম্প্রতিককালের এক জরিপে দেখা গেছে, গ্রামাঞ্চলে শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ কৃষি কাজে জড়িত । অথচ পূর্বে এর পরিমাণ ছিল শতকরা ৮০ ভাগ। অপ্রাতিষ্ঠানিক কারিগরী শিক্ষার প্রসারের ফলে অকৃষিখাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে। এখনও গ্রামে কৃষিখাতে নিয়োজিত শ্রমের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ অকৃষি মৌসুমে বলতে গেলে বেকারই থাকে। তাদের মধ্যে স্বীয় উদ্যোগে গ্রামীন কারিগরী জ্ঞান যেমন- মাছ ধরার বিভিন্ন হাতিয়ার তৈরি, কৃষি কাজে ব্যবহৃত বাঁশ ও বেতের বিভিন্ন দ্রব্য (ডাল, কুলা, চালুনি) তৈরির মাধ্যমে তারা অকৃষি মৌসুমেও কাজে নিয়োজিত থাকে। গ্রামের মানুষের শ্রম আছে। এ শ্রমের সাথে কারিগরী জ্ঞানের মিশ্রণ গ্রামীণ দারিদ্র্য দূর করতে পারে।

শিক্ষিত বেকার ও নিরক্ষর বেকারদের যদি বিভিন্ন ট্রেডকোর্স যেমন- মোটর ড্রাইভিং, ওয়েল্ডিং, ইলেকট্রিক, কার্পেন্ট্রি, টাইপিং, প্রিন্টিং, সেলাই প্রভৃতি কারিগরী বিষয়ে জ্ঞান দান সম্ভব হয়, তাহলে দ্রুত বেকার সমস্যার হাত থেকে দেশ মুক্তি পেতে পারে।

বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান ১৯৮৭ অনুযায়ী দেশে বর্তমানে নিম্নোক্ত ৯৮টি কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। (১) পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ১৮টি (২) ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ৫৪টি (৩) কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট ১৬টি (৪) প্রকৌশল মহাবিদ্যালয় ৪টি (৫) কৃষি মহাবিদ্যালয় ২টি (৬) গ্লাস ও সিরামিক ইনস্টিটিউট ১টি (৭) গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউট ১টি (৮) লেদার টেকনোলোজি কলেজ ১টি (৯) টেক্সটাইল টেকনোলোজি কলেজ ১টি -সর্বমোট ৯৮টি সরকারি অর্থ সাহায্যে পরিচালিত। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে যারা ডিগ্রি বা সনদ নিয়ে বেরুচ্ছে, তাদের সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। অপরদিকে সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বহুগুণ বেশি। তবে আশার কথা হলো, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীরা সাধারণ শিক্ষিতদের তুলনায় তাড়াতাড়ি চাকরি পাচ্ছে। দেশের সার্বিক উন্নয়নে এদের ভূমিকাও ব্যাপক। এ সত্যটি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের কণ্ঠেও ধ্বনিত হয়েছে। সম্প্রতি তাঁর সম্মানে ঢাকায় আয়োজিত এক সংবর্ধনা সভায় তিনি বলেন- বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির জন্য ক্ষুদ্র শিল্পে বিনিয়োগ অপরিহার্য। সমাজের বর্তমান লক্ষ লক্ষ বেকার যুবকের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য কারিগরী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটানো এখন অত্যাবশ্যক।

সম্প্রতি সরকার দেশের শিক্ষিত বেকারদেরকে কারিগরী শিক্ষাদানের জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এই লক্ষ্যে সরকারের শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি যুব অধিদপ্তরও বেকার যুবকদেরকে কয়েকটি ট্রেড কোর্সে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছে। আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষার বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে আমরা দেখতে পাই, দেশের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় পাঁচটি সাধারণ বিষয়ে ডিগ্রি দিচ্ছে। উচ্চ ডিগ্রিধারীদের বেশির ভাগই আজ বেকারত্বের অভিশাপে চরম হতাশাগ্রস্ত। বিষয়টির ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে সম্প্রতি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অধিবেশনে বক্তৃতাকালে উপাচার্য অধ্যাপক কাজী সালেহ আহমদ বলেন, “এদেশের উচ্চ শিক্ষার শতকরা সত্তর ভাগ পাঠ্য বিষয়ই কর্মসংস্থানের সহিত সংগতিবিহীন”। খুব সম্ভবতঃ এই কারণেই দেশে এখন চার লক্ষেরও বেশি উচ্চ শিক্ষিত বেকার যুবক রয়েছে। বলাবাহুল্য, এদের বেশির ভাগই সাধারণ বিষয়ে ডিগ্রিধারী। সরকারি চাকরি না পেলেও বৃত্তিমূলক বা কারিগরী বিষয়ে ডিগ্রিধারীরা অর্জিত শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে আত্মকর্মসংস্থান করতে পারে। কারিগরী বিষয়ে শিক্ষিত ব্যক্তিদেরকে ব্যাংকও এখন ঋণ সুবিধা প্রদান করছে। কারিগরী শিক্ষায় শিক্ষিত জনশক্তি দেশের উন্নয়নে যেমনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে, তেমনি এই জনশক্তিকে বিদেশে রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা সম্ভব। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড তাদের কারিগরী শিক্ষিত জনশক্তিকে বিদেশে বিশেষতঃ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রপ্তানী করে নিজেদের বেকার সমস্যা বহুলাংশে হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছে। অপরদিকে প্রাশ্চাত্যের দেশগুলোর মধ্য চীন, জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান প্রভৃতি শিল্পোন্নত দেশগুলোর শিক্ষিত জনশক্তির অধিকাংশই কারিগরী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশকে উন্নতির শীর্ষে পৌঁছে দিচ্ছে। সেজন্য বলা চলে, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যার সমাধান করতে হলে কারিগরী শিক্ষার প্রতি অধিকতর গুরুত্বারোপ করতে হবে, প্রতিষ্ঠা করতে হবে আরও অধিক সংখ্যক কারিগরী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এতে করে দেশের সার্বিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হবে- হ্রাস পাবে বেকার সমস্যা। আমাদেরকে ভুলে গেলে চলবে না যে- বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ, কারিগরী জ্ঞানের যুগ। আর এই কারিগরী জ্ঞানই বেকারত্বের অভিশাপ থেকে দেশকে যেমনি মুক্ত করতে পারে তেমনি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও দ্রুত পাল্টে দিতে সক্ষম।

(১৯৮৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার আগষ্ট সংখ্যায় মুদ্রিত)