কর্মচঞ্চল ঢাকার রাজপথে প্রতিদিন প্রতিক্ষণে পথ চলতে কত দৃশ্যই না চোখে পড়ে। কোনটা মনে আলতোভাবে ছুঁয়ে যায়, কোনটা মনের গভীরে রেখাপাত করে, আবার কোনটা সাংঘাতিক সংঘাতময় হয়ে রাজ্যময় তোলে ধিক্কারের ঝড়।
কিন্তু যে দৃশ্যটা দেখে সবচেয়ে বেশি বিচলিত হই তা হল, রাতের বেলায় রাস্তার ধারে নিরন্নে আর নিঃশব্দে পড়ে থাকা (শুয়ে বসে) অসহায় আর দুর্ভাগা মানুষগুলোর করুণ দৃশ্য।
কতগুলো দৃশ্য যে আবার পুলকিত করে না তা নয়, যেমন- বড় বড় হোটেলের পুষ্প প্রদর্শনী, কুকুর প্রদর্শনী, ফ্যাশান প্রতিযোগিতা অথবা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বা পার্কের আড়ালে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে বা শুয়ে থেকে প্রেম-ভালবাসার স্বার্থক রূপায়ণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ স্বার্থক লোকগুলো। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা তথা অফিস পাড়ায় অফিস চলাকালীন সময়ে কোন কোন কর্মকর্তার কৃপা সাক্ষাতে যখন আর্থ-সামাজিক এবং ব্যবসা-বাণিজ্যিক অবস্থার সর্বশেষ উন্নতি বা অবনতির কথা কান পেতে শুনি, তখন আর নিজেকে সামলাতে পারিনে, যেখানে পরিসংখ্যানের হিসাব মত করে তারা বলে থাকেন- যে পরিমাণ সময় আমাদের জাতীয় জীবন থেকে ক্ষয়ে যাচ্ছে- ঠিক ততখানি আমরা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ছি। আর ক্রমান্বয়ে আমাদের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে পড়ছে।
সময় অতিক্রম করা একটা জাতির জীবনে কোন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা বা ফ্যাক্টর নয় বরং অতিবাহিত সময় কোন অগ্রগতি বা উন্নতির ইঙ্গিত বহন করছে কিনা, সেটাই মূলতঃ বিবেচ্য বিষয়। জনৈক মনীষী বলেছেন “জীবনে যদি অগ্রগতি না থাকে তবে সে জীবন অবাঞ্ছিত”।
অথচ আমরা অগ্রগতির বিচার বিবেচনা না করে সাময়িক পরিতৃপ্তি অথবা সহজ-সুলভ করতালি পাবার প্রত্যাশায় আসল ব্যাপারটাকে ঢেকে রেখে সর্বদাই অর্থনৈতিক অগ্রগতি বা জাতীয় আর্থ-সামাজিক উন্নতির গলা-ফাটানো বক্তৃতা শুনতে ও দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন সভা বা টেলিভিশনের রঙিন পর্দায়। সে মূহুর্তে আমাদের মনেও রং লাগে।
কিন্তু সে অগ্রগতি কি আদৌ অর্থনৈতিক, নাকি জাতীয় স্বার্থের নামে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার বানানো বুলি। না, সে প্রসঙ্গে ছিটকে না পড়ে বরং আমাদের আলোচ্য বিষয় তথা বাংলাদেশের স্বর্গশহর ঢাকার দিকে আসি। ঢাকা ইদানিং চমৎকার শহর। ক্ষণে ক্ষণে চেকনাই ঝিকিয়ে ওঠে ঢাকার নবনির্মিত বিদেশী কারুকাজ করা বহুতলা বিল্ডিংগুলো। ছবির বা পত্রিকার ক্যামেরাম্যানগণ দর্শক বা পাঠকদের ধাঁ ধাঁ লাগানোর জন্য প্রথমেই কায়দা করে ক্যামেরার লেন্স স্থাপন করবে সুরম্য একটা বিল্ডিংয়ের ওপর। পরমূহুর্তেই আস্তে ধীরে ক্যামেরাটি ঘুরিয়ে নেবে নীচের দিকে। যেখানে সমতল ভূমি এবং প্রচুর ঘরবাড়ি। দেখে ভ্রম হয়, এগুলো কি মানুষের ঘর বাড়ি?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে হয়- হ্যাঁ, এগুলো মানুষেরই ঘর-বাড়ি। মাথার ওপর এক দুটো টিন কিংবা চাটাই ফেলা, চারপাশে চট কিংবা দরমার বেড়া। দরজা বলতে কিছু নেই, জানালার তো কোন প্রশ্নই ওঠে না।
এরকম হাজার হাজার ঘর ছড়ানো ছিটানো রয়েছে ঢাকা শহরে- যেন শিশু শিল্পীদের হাতে আঁকা এলোমেলো ছবি। দুঃখের সাথে বলতে হয় বাংলাদেশে শতকরা ৩৭ জন মানুষ এরকম ঘর-বাড়িতে বাস করে। যাদের ঘর-বাড়ির নাম বস্তি। আর এই বস্তির কিলবিলে মানুষগুলোকে আমরা বলি বস্তিবাসী।
এই বস্তিবাসীদের নিয়ে বিদেশী টেলিভিশন চ্যানেলে সর্বদাই দেখানো হয় ৪৫ মিনিটের এক নাতি-দীর্ঘ ডকুমেন্টারী ফিল্ম, যে ছবি শুরু হবার এক মিনিট পরই দর্শক টের পেয়ে যান- পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু পাঁচ মিনিটের বেশি কি এই ছবি দেখা যায়? বুক ফেটে যাবে না?
বস্তিবাসীর মূল গল্পটি মোটামুটি এরকম, তবুও এ প্রসঙ্গে আরো কিছু বলার থেকে যায়। বন্যা এবং দুর্ভিক্ষই প্রধানতঃ গ্রাম বাংলার মানুষদের উদ্বাস্তু করে তোলে। বিশেষ করে গ্রামের দিনমজুর এবং ভূমিহীন কৃষকরাই বন্যা ও দুুর্ভিক্ষের শিকার হয়। খাদ্য এবং কাজের অভাবে, মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের অভাবে তারা শহরে আসে, তৈরি হয় বস্তি।
বস্তিতে জীবনযাপন করার সুযোগে দু’একজন চতুর লোক প্রচুর পয়সার মালিক হয়ে যায়। দু’টো পদ্ধতি দিয়ে এই মুষ্টিমেয় লোক টাকা বানায়। এক- চোরাচালানী, দুই- মেয়ে ব্যবসা। দুর্ভিক্ষ-মহামারী-নদীভাঙ্গন-বন্যা ইত্যাদির শিকার গ্রামের নিরীহ দরিদ্র ভূমিহীন কৃষক, দিনমজুর, হাজার বছরের ইতিহাস যাদের একরকম- মুলতঃ এরাই শহরে চলে আসে, গড়ে তোলে বস্তি। নতুবা রাস্তার ধারে ফুটপাত, পার্ক, মসজিদ বা বাড়ির বারান্দা ইত্যাদি হয় এদের বিশ্রামাগার বা আবাসস্থল। এরা প্রতিদিন এবং সারাজীবন ঘরহীন ঘরে অবস্থান করে।
ঢাকা মহানগরীর বিশেষ কতগুলি এলাকা অবলোকন করলে শহরটাকে বেশ স্মার্ট বলেই মনে হয়। অথচ তার পাশাপাশি এ শহরেই উল্ল্যেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ উদোম, ন্যাংটা ও বড্ড অসহায়ভাবে মুক্ত পশু-পাখির মত দিন কাটায়। এরাও নগরে বাস করে। অথচ নাগরিক জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য ওদের আদৌ স্পর্শ করে কি?
অভাব, দারিদ্র্য ও ক্ষুধা মানুষকে শহরের দিকে টেনে আনে। গ্রামের শান্ত ও স্নিগ্ধ জীবন ছেড়ে শহরাভিমূখী মানুষের এই মিছিল এসে থামে ফুটপাতে ও বস্তিতে। গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের সংখ্যা ঢাকায় সবচেয়ে বেশি। এদের আশ্রয় স্থলগুলো যাবতীয় অসামাজিক কার্যকালাপের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু কেন? এই কেন-এর উত্তর খুঁজে বের করার কেউ চেষ্টা করে কি? সরকার, সমাজপতি বা রাজনৈতিক কেউই করে না।
ঢাকায় এসে ভাগ্যহীন এসব লোকগুলোর স্বপ্ন দু’দিনেই ভেঙ্গে যায়। দেখে, এই শহরের মানুষগুলো বড় নির্মম। কাজের দেখা মেলেনা, খাদ্যেরও না। যেকোন কাজের ধান্দায় ঘুরে বেড়ায়, কেউ কাজ দেয় না । খিদের জ্বালায় হাত পাতে মানুষের কাছে, দূর দূর করে তাড়া খায়। অর্ধাহারে অনাহারে কোন মতে বাঁচার উপায় করে আরো অনেকের মত এরাও ঠাঁই করে নেয় ফুটপাত বা বস্তিতে। এদের জীবনযাপন দেশ ও জাতির কাছে গুরুতর প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিলেও এই সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার কোন ফলপ্রসূ উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
দুর্ভাগা এ মানুষগুলো শুধু স্বার্থকামী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ক্রীড়নক হচ্ছে। কিছু কিছু রাজনৈতিক দল এদেরকে প্রলোভন দিয়ে তাদের সভা-মিছিলে হাজির করিয়ে এর বিশালত্ব দেখায়। উদ্দেশ্য হাসিলের পর আর ফিরেও তাকায় না। ফলে এদের জীবন ধারা কোন কালেও পাল্টায় না।
তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মানুষের মাথাপিছু যে আয় এবং জীবনধারণের যে ভয়াবহ পরিস্থিতি, তাতে দারিদ্র্যসীমায় ও দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী এইসব ছিন্নমূল মানুষের পরিসর ক্রমান্বয়েই দীর্ঘতর হচ্ছে। একে ঠেকানোর কোন ক্ষমতাই বুঝি কারোর নেই। জীবনধারণের ক্রমাগত কঠিন সমস্যার আবর্তে এবং বেকার সমস্যা সৃষ্টি হওয়াতে ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে এই সমস্যা। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনসংখ্যার যে আধিক্য এবং সীমিত সম্পদের এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা যে বিস্ফোরোন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, তাতে আপনিই তৈরি হয়ে যায় সমস্যার ক্ষেত্র।
ফুটপাত আর বস্তির এই লোকগুলো বাঁচতে চায়। বাঁচার জন্য এদের শহর প্রয়োজন। আবার শহরেরও প্রয়োজন ওদের। কিন্তু এমন অসহায় ও নিঃগৃহীত জীবন যাপনে ওদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এদের জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পূনর্বাসন কর্মসূচি, গ্রামে অথবা শহরে। কিন্তু কার্যত আমাদের সরকার এ ব্যাপারটির প্রতি কতখানি মনোযোগী ও আন্তরিক তা অবশ্যই ভেবে দেখার বিষয়।
আমরা যারা নাগরিক জীবনে উচ্চবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত কিংবা সহজ-স্বচ্ছন্দ জীবন যাপন করছি, বাস্তুহারাদের দুঃখ-দৈন্যময় জীবনের প্রভাব কম বেশি আমাদের ওপরেও একটা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে বৈকি। কেননা এদের এই দৈনন্দিন অথর্ব জীবনযাত্রাকে আমাদের পরিবেশ থেকে পৃথক করা যায় না। তাই সরকার-সমাজপতি-রাজনীতিক, উচ্চবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত সকলেরই এদের সহযোগিতায়- পূনর্বাসনে এগিয়ে আসা শুধু প্রয়োজনই নয়- অপরিহার্য হয়েও দাঁড়িয়েছে।
(১৯৮৯ সালে লক্ষ্মীপুর বার্তা পত্রিকায় মুদ্রিত)