Sun Sun Sun Sun Sun
English

সৃষ্টিজগতের ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং সুউন্নত জাতি গঠনে

পূর্বসূরী ও উত্তরসূরীর পারস্পরিক দায়িত্ব—কর্তব্য

|| ড. এম হেলাল ||
সৃষ্টি জগতের ধারাবাহিকতা রক্ষায় বিশেষত মানব প্রজন্মের ক্রমবিকাশে সৃষ্টি হয়েছে উত্তরসূরী ও পূর্বসূরী। সুযোগ্য উত্তরসূরী গঠনের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হচ্ছে পরিবার। পারিবারে স্রষ্টার দেয়া শ্রেষ্ঠ নেয়ামত হলো সন্তান; যারা পরিবারের অনিবার্য উত্তরসূরী তথা দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কান্ডারী। পূর্বসূরী—পিতার রেখে যাওয়া কর্মযজ্ঞ ও কর্মফল বিশেষত সুনাম—সম্মানসহ সকল সম্পদ ও সম্পত্তি উত্তরসূরী—সন্তানের জন্য পরম নিয়ামক প্রাপ্তি।

পূর্বসূরীর দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে- স্রষ্টার অনুকম্পায় প্রজন্ম তৈরি তথা উত্তরসূরী সৃষ্টি এবং তাদেরকে লালন—পালন, পথনির্দেশনা, নিরাপত্তা বিধান ইত্যাদি। এছাড়াও পিতা—মাতা দু’জনে বৈবাহিক রজ্জু—রশির অটুট বন্ধনে আজীবন সন্তান—সন্ততিসহ পুরো পরিবারকে সুদৃঢ় ও মজবুতভাবে বেধে রাখা পূর্বসূরীর অন্যতম দায়িত্ব।

অন্যদিকে উত্তরসূরীর দায়িত্ব হচ্ছে- পূর্বসূরী তথা জন্মদাতা পিতা—মাতার আনুগত্য বজায় রাখা এবং তাদেরকে অঁাকড়ে থাকা। এই অঁাকড়ে থাকাটা এতই প্রতিজ্ঞা—প্রতিশ্রম্নত হতে হবে যেÑ উত্তরসূরীদের কিংবা পূর্বসূরীদের কেউই কোনোই ছলে, কোনোই অজুহাতে, কোনোভাবেই পরিবারচ্যুত বা বংশচ্যুত কিংবা কেন্দ্রহারা বা নীড়হারা হতে পারবে না। কেউ পথভ্রষ্ট বা বিপথগামী হয়ে পরিবারচ্যুত হতে চাইলে যেকোনো উৎসর্গ—অবদানের মাধ্যমে ও সুউচ্চ মূল্য দিয়ে হলেও তাকে পরিবারে ফিরিয়ে আনতেই হবে। এটিই হচ্ছে প্রকৃত ও আদর্শ পরিবার বন্ধন তথা পরিবার প্রথা।

উত্তরসূরীর অতীব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে- পূর্বসূরীর আদর্শ অনুসরণ ও অসমাপ্ত কাজ শেষ করা এবং তা পূর্বসূরীর জীবদ্দশায় কিংবা মৃত্যুদশায় যেকোনো অবস্থায় ভালোবেসে নিজ সাধ্যমতো করতে থাকবে। আর এ কারণেই জন্মদাতা বিশেষত পিতা যে ধর্ম পালন করেন বা করতেন, উত্তরসূরী হিসেবে সন্তানকে সেই ধর্মই পালন করতে হয়; এরূপ প্রথা বা নিয়মই মানব সৃষ্টিলগ্ন থেকে চলে এসেছে।

পূর্বসূরীর জীবন—দর্শনের লালন—পালন—বিকাশ, তার অসমাপ্ত কাজ সম্পাদন, তার আদর্শ ও কর্ম যথাসাধ্যভাবে কালান্তরে ধরে রাখার জন্যেই সাধারণত পূর্বসূরীর সম্পত্তি—সুনাম—সমৃদ্ধি—ক্ষমতার মালিকানা দেয়া হয় উত্তরসূরীকে। পূর্বসূরী তার সর্বকিছু চিরস্থায়ী আমানত হিসেবে উত্তরসূরীর কাছে রেখে সম্পূর্ণ খালি হাতে চলে যান পরপারে এবং তা করে যান একমাত্র এই অলিখিত শর্তে যে, উত্তরসূরী তার সম্পত্তি ও সম্পদের তথা কোনো আমানতের কোনোরূপ খেয়ানত না করে যথাযথ সংরক্ষণ ও ব্যবহার করবে এবং তা কিন্তু পূর্বসূরীর জীবন—দর্শন, ইচ্ছা—অনিচ্ছা ও অসমাপ্ত কর্ম—আদর্শ সম্পাদনের আলোকে।

সংগত কারণেই যদি পূর্বসূরীর আদর্শ লালন—পালন ও অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার ইচ্ছা ও দায়িত্ব পালনে অনীহা, অপারগতা কিংবা শৈথিল্য কোনো উত্তরসূরীর চিন্তা বা কর্মে থেকে থাকে; তাহলে সেক্ষেত্রে পূর্বসূরীর কোনো সম্পত্তি কিংবা সম্পদের মালিকানা এমনকি ব্যবহারের দাবিও উত্তরসূরীর অন্যায়, প্রবঞ্চনা ও প্রতারণা বলে গণ্য হতে পারে।

পূর্বসূরীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে বর্তমান সময়ের অতি আধুনিক কিছু উত্তরসূরী অনীহা ও অপারগ হয়ে নষ্ট করছে পারিবারিক ভালোবাসা, ভেঙ্গে দিচ্ছে পরিবার প্রথার অমিয় মেলবন্ধন তথা উত্তরসূরী ও পূবসূরীর চিরস্থায়ী সম্পর্ক।

আমার প্রত্যক্ষ জানামতে একটি পরিবার রয়েছে, যেখানে পিতার সাথে তথা পূর্বসূরীর সাথে উত্তরসূরীরা কোনো সম্পর্ক রাখেনি; বছরের পর বছর একা নির্জনে পড়ে থাকা পূর্বসূরীর কোনো খেঁাজখবর রাখেনি; পূর্বসূরী বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় এমনকি ICU তে জীবন—মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অত্যন্ত সংকটাপন্ন অবস্থায়ও যারা একটি রাত কিংবা দিনের সামান্য ক্ষণও কাছে থাকার ন্যূনতম দায়িত্ব কিংবা কর্তব্যবোধ করেনি। এরূপ মানুষরূপী কোনো অমানুষ কি উত্তরসূরীর দাবিদার হতে পারে? কিংবা পূর্বসূরীর অবর্তমানে তার কষ্টার্জিত সম্পদের মালিকানা পেতে পারে?

পূর্বসূরীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা, তার কর্ম ও আদর্শ লালন—পালন না করা, তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের হাল না ধরা এবং পূর্বসূরীর মৃত্যুর আগে ও পরে তার চিন্তা ও পরিকল্পনার অসমাপ্ত কাজ সম্পাদনে প্রতিজ্ঞা—প্রতিশ্রম্নতিহীন কিংবা পরিবার—কেন্দ্র থেকে বিচ্যুত বা পথভ্রষ্ট কেউ কিংবা সৃষ্টির ধারাবাহিকতা রক্ষার পথে কলঙ্কিত কেউ কি পূর্বসূরীর কঠিন কষ্ট—শ্রমে অর্জিত সম্পত্তি—সুনামের মালিক হওয়া উচিত? সবশেষ কথা হচ্ছে উত্তরসূরীর প্রতি পূর্বসূরীর যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনি পূর্বসূরীর প্রতি উত্তরসূরীরও দায়িত্ব আছে। এক্ষেত্রে তারা একে অপরের পরিপূরক। উত্তরসূরীর বাল্যকালসহ পরিণত বয়সে পড়াশোনা, চাকরি, ব্যবসা—বাণিজ্য, বিয়ে ইত্যাদিতে পূর্বসূরীর যেমন ভূমিকা থাকবে, তেমনি পূর্বসূরীর বৃদ্ধাবস্থায় এবং মৃত্যুর পরে উত্তরসূরীর তেমনি ভূমিকা থাকবে।

উত্তরসূরীও একদিন সময়ের অমোঘ নিয়মে পূর্বসূরীতে পরিণত হবে। তারও সন্তানাদি তথা উত্তরসূরী হবে। এভাবেই সময়ের নিয়মে সকল উত্তরসূরীই একদিন পূর্বসূরীতে পরিণত হয়। সময়ের নিয়ম বড় কঠিন ও নির্মম। সময় কাউকে ছেড়ে দেয় না। সবার শরীরেই সময় তার নিষ্ঠুরতার আঁচড় বসায়। কাজেই সময় থাকতে সময়ের কাজ সবাইকে করে যেতে হবে। তাহলেই পূর্বসূরী ও উত্তরসূরীর পারস্পরিক সুসম্পর্ক রক্ষা ও পরস্পরের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালনের মেলবন্ধনে একটি সুউন্নত দেশ ও জাতি গঠন করা সম্ভব।

লেখকঃ

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক

ফোনঃ ০২—৪৭১২২৪৬৩, ০২—৯৫১৫০৯৯

web: www.helal.net.bd

e-mail: m7helal@yahoo.com